সি নে দু নি য়া
অভিষেক ঘোষ
'বেলাইন' (২০২৪)... বিভ্রম ও বিরতির সন্নিধি
২০২০ সালে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল, নাটালি এরিকা জেমস্ পরিচালিত ‘Relic’, ‘Dementia’ বা, বিস্মৃতি সেই ছবিতে ছিল এলিমেন্ট অব হরর, ভয়ের উপাদান। ভিস্যুয়াল রিপ্রেজেনটেশনে তুলে ধরা হয়েছিল ভীতিপ্রদ বিস্মৃতির মগজ-দেওয়ালচিত্র। ১৯৬৩ সালের মাস্টারপিস্ ‘Shock Corridor’, স্করসেসির সুবিখ্যাত ‘Shutter Island’ (২০১০) বা, ওরিওল পাউলোর সাম্প্রতিক সৃষ্টি ‘God’s Crooked Lines’ (২০২২) – মানসিক রোগ, স্মৃতি-বিস্মৃতি, মনস্তত্ত্বিক বিশ্লেষণে মানুষের নানাবিধ অক্ষমতা ও অজ্ঞানতা নিয়ে হরেক রকম ট্রিটমেন্টে থ্রিলারধর্মী বহু ছবি ইতিপূর্বে নির্মিত হয়েছে। ‘বেলাইন’ তাতে নবতম সংযোজন বলব না, তবে অভিনব সংযোজন বলা যেতেও পারে।
তবে গল্প এক লাইনও বলব না, বললে আপনারাই পরে বলবেন… ঠকিয়েছি! আসলে এটাই ছবির গল্প! মহামান্য গদার বলেছিলেন, “…cinema is truth twenty four times a second.” যদি এতে সংশয় থাকে, দেখে নিন আরেকজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল হ্যানেকে কী বলেছেন… “Film is 24 lies per second at the service of truth, or at the service of the attempt to find the truth.” ‘বেলাইন’-ও আসলে তাই, অবিরত চেনামুখ ও অকপট রোজনামচার আড়ালে পরিচালক শমীক রায়চৌধুরী সাসপেন্স থ্রিলারের ছদ্মবেশে আসলে হাজির করেছেন এক সাইকোলজিকাল ড্রামা। বিভ্রমের ছায়া-পথে খুঁজতে চেয়েছেন হারিয়ে ফেলা, ভুলে যাওয়া ও আঁকড়ে বাঁচার কষ্টকর সত্যকে। বয়স অনেক কিছু কেড়ে নেয়, স্মৃতি ও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মানুষ; কিন্তু কিছু জিনিস থেকে যায়। একটা বয়সের পরও যখন সেই সব চাহিদা, দুর্মর বাসনা, পার্থিব আকাঙ্ক্ষা থেকে বিরতি মেলে না, তখন তা আমাদের চোখে বিশ্রী, বিকট, বিকৃত বলে মনে হয়। ‘বেলাইন’ তাই চেনা লাইনে চলেই না; ধরে রঙ্-রুট, বেলাইন। গল্প বলে এক বৃদ্ধের একাকিত্বের, নিরাপত্তাহীন দিন-রাতের, কোষ্ঠকাঠিন্যের (Constipation), রতি-তাড়নার ও আরো নানা বাসনার। কিন্তু গল্পের থেকেও এই ছবিতে বেশি আকর্ষণীয় গল্প বলার ভঙ্গি। ভিস্যুয়াল স্টাইল, প্রেজেন্টেশন, আলোর ব্যবহার, সাউন্ড ডিজাইন – এই ছবিতে দুর্দান্ত। বৃদ্ধের চরিত্রটি (অভিনয়ে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনে শুধুই কি এক যুবতীর ব্যক্তিগত পরিসরে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করেন? তাঁর দিনলিপির সবটাই কি মিথ্যে? টিভি-সিরিয়ালই কি একমাত্র জাগতিক সত্য? নাকি বোকাবাক্সতে বন্দি আমরা আসলে এটাই করে থাকি? আমরা কি লুকিয়ে চুমুক দিতে চাই অন্যের জীবন-পেয়ালায়? শ্রেয়া ভট্টাচার্য অভিনীত চরিত্রটির তৃষ্ণা, ক্ষোভ, অবদমন; তার লিভ-ইন পার্টনার ছেলেটির হতাশা, চালাকি, রাগ, কষ্ট – সবই কি তবে এক বৃদ্ধের কষ্ট-কল্পনা! নাকি সবটাই ঘটছে! প্রতিটা ফোন-কল আসলেই কি ঘটছে বাস্তবে? দু-প্রান্তের বার্তালাপ স্পষ্ট শুনছি আমরাও! – এইখানেই আসলে শুরু হয় আরেকটা খেলা… আমরাও যে আসলে আমাদের মনোজগতে ওই বৃদ্ধের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নই, সেটা বুঝিয়ে দিতে ছাড়েন না পরিচালক। কে কতটা অসুস্থ, সেটা বোঝা বড়ো সহজ নয়। আমরা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি সম্পর্কে এক ঘন্টা কুড়ি মিনিটে প্রায় কিছুই জানতে পারি না। যেটুকু জানি, তাও আসলে তাঁর অবচেতন। একটা একলা ঘর, যার প্রতিটি দেওয়াল যে-কোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে অসুন্দর সাদা-কালো সেকেলে-টেলি ঝিরঝিরে! সেখানে স্বপ্নের জগৎ থেকে পতন নিশ্চিত। স্বমেহনের বাস্তবতা রঙের বিন্যাসে তাই হয়ে পড়ে পরাবাস্তব – ঘরময় জলরাশি আসলে যে কামজল। সেখানে আতঙ্ক আসে নানাভাবে… সিরিয়ালের চরিত্রদের জীবনে দাম্পত্য-কলহ, সন্দেহ, অসহিষ্ণুতা ভীতিপ্রদ; কিন্তু বাস্তবে! দরজায় কার পদশব্দ, কার শরীরের ছায়া! বাংলা সিনেমার সাম্প্রতিক প্রক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই ছবির নির্মাতাদের এইজন্যই সাধুবাদ দিতে হয়, কারণ তাঁরা যা করতে চেয়েছেন ও করেছেন, এতটা ‘বেলাইন’-এ হাঁটার সাহস এই বাংলায় আজকাল খুব কম লোকেই দেখান। আর কে না জানে, চেনা পথের গোলকধাঁধা না ছাড়লে না তো যায় এগোনো, না তো খুঁজে নেওয়া যায় নতুন দেশ।
এভাবেই শব্দ ও দৃশ্যের ম্যাজিকে প্রতিটি শটকেই বেশ টানটান, চমকপ্রদ করে তুলেছেন ‘বেলাইন’-এর নির্মাতারা। লুডো খেলার দৃশ্যটি যেভাবে শেষ হয়, সেটাই আন্দাজ দেয় গল্পে ট্যুইস্ট আছে, আপনি অনুমান করলেও সবটা অবশ্য কিছুতেই ধরতে পারবেন না – এইখানেই শিল্প নির্দেশনা, ক্যামেরা (সুপ্রিয় দত্ত) ও সম্পাদনা (সংলাপ ভৌমিক) পরিচালককে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সিনেমা-সিরিজের দর্শকেরা কিছুটা অনুমান করলেও, শেষে কী হবে পুরোপুরি ধরতে ব্যর্থই হবেন। কেন? কারণ ছবিটা যা কিছু বলতে চায়, বলে শব্দ ও দৃশ্যে; সংলাপে নয়। এই ছবির সংলাপ, পরাণবাবুর ডেলিভারি, কমিক টাইমিং, সায়নের লাউড অ্যাক্টিং, এমনকি অনেক চরিত্রের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ – সবই বিভ্রম। টেলিভিশন-মিস্ত্রির চরিত্রটিকে শেষবার কীভাবে দেখা যায়, খেয়াল করতে ভুলবেন না। সুতরাং বক্তব্য এই যে, ‘বেলাইন’ শুধু একটা গল্প বলে না, ‘সিনেমা’ হয়ে ওঠে। অজস্র মিথ্যের চোরাগলিতে অনুসন্ধান করে ফেরে অবলুপ্তির সত্যকে, অনেকাংশে সফলও হয়। এই শহর, এই দেশ, এই পৃথিবীর বুকে কত লক্ষ-কোটি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এ’ভাবেই প্রতি মুহূর্তে হারিয়ে ফেলছেন বাস্তবের চেনা-পথ, হারিয়ে ফেলছেন নিজেদের, অবিরত; আমরা কবেই-বা তাঁদের খবর রাখি? আর সেই সঙ্গে আমরা এই খবরও রাখি না বোধহয়, আমাদের অগোচরেই ‘বেলাইন’-এর মতো ভালো বাংলা ছবি দ্রুত হারিয়ে যায়– চাইলে যাদের পাশে দাঁড়িয়ে দু-দণ্ড বিস্ময়-মথিত বাহবা বিলোনোই যায়!
ফিল্ম : বেলাইন (২০২৪)
পরিচালক: শমিক রায়চৌধুরী
অভিনয়ে: পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রেয়া ভট্টাচার্য, তথাগত মুখার্জি প্রমুখ।
ভাষা: বাংলা
Facebook Comments